করোনাকালে অনলাইন শিক্ষা বাংলা প্রবন্ধ রচনা | অনলাইন শিক্ষার সুবিধা অসুবিধা

নামের উৎপত্তি: ‘করোনা ভাইরাস’ নামটির উৎপত্তি লাতিন শব্দ ‘করোনা’ থেকে, যার অর্থ ‘মুকুট’ বা ‘হার’। ‘করোনা’ শব্দটি নিজে গ্রিক Kopwvn Korone থেকে এসেছে যার অর্থ ‘মালা’ বা ‘হার’ নামটি ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে ভিরিয়নের বৈশিষ্ট্যমূলক উপস্থিতিকে নির্দেশ করে। আজকের পোস্টে করোনাকালে অনলাইন শিক্ষার সুবিধা অসুবিধা রচনা শেয়ার করলাম। 

করোনাকালে অনলাইন শিক্ষা বাংলা প্রবন্ধ রচনা

“অতিমারি যখন বন্ধ করেছে সব, শেষ করেছে সব আশা 

দিগন্তে তখনও আলোর শিখা, অনলাইন শিক্ষাই তো ভরসা।”

ভূমিকা:

বিশ্বের সকল মানুষের কাছে আতঙ্কের এক নতুন নাম হল করোনা ভাইরাস (Covid 19)। 1930 সালে এ ভাইরাসের আলোচনা শুরু হলেও 1960 এর দশকে করোনা শনাক্ত নিশ্চিন্ত করা যায়। তবে 2020 সালের 11 ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য এর নাম দেন Covid-19 এবং রোগ বহনকারী ভাইরাসের নাম দেওয়া হয় Sars-Cov – 2 এবং 2020 সালের 11 মার্চ যাকে বৈশ্বিক মহামারি হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

চিনের উহান প্রদেশে সর্বপ্রথম এর খোঁজ মিললেও এর করাল গ্রাসে বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ পতিত হয়েছে স্থবিরতায়, হয়েছে প্রায় 20 কোটির মতো মানুষ এবং মৃত্যু ঘটেছে প্রায় 40 লক্ষের অধিক মানুষের, অচল হয়ে পড়েছে অর্থনীতির চাকা, বন্ধ হয়েছে বিশ্বের অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তার মধ্যে বাদ যায়নি আমাদের ভারতও। মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা।

অসংখ্য ছাত্রছাত্রী যারই প্রভাবে খাতা কলমের সান্নিধ্য ছেড়ে আসক্ত হয়ে পড়েছে মোবাইল গেমসে, কিশোর গ্যাং সহ বিভিন্ন নেশায়। আর এই পরিস্থিতিতেই উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিতে অনলাইন শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

অনলাইন শিক্ষা কী?

অনলাইন শিক্ষাকে ব্যাপক অর্থে Elearning বলা হয়ে থাকে। Elearning হল আসলে Electronic learning বা বৈদ্যুতিক শিক্ষা ব্যবস্থা। অর্থাৎ, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্র দ্বারা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাপসের সাহায্যে দূরস্থান থেকে যে শিক্ষা প্রদান বা গ্রহণ করা হয় তাকেই অনলাইন শিক্ষা বলা হয়। যেক্ষেত্রে Zoom, Google Class Room, Facebook live, Edmodo ইত্যাদি। অ্যাপসের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক সংযোগ দিয়ে এন্ড্রোয়েড মোবাইল সেট, ট্যাবলেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদির সাহায্যে ক্লাস বা পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে।

অনলাইন শিক্ষার সুবিধাসমূহ:

অনলাইন শিক্ষা আমাদের শিক্ষাজীবনে অনেক সুবিধা করেছে। তার মধ্যে কয়েকটি তুলে ধরা হল—

  1. অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীকে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হয় না। নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে মোবাইলের মাধ্যমেই ক্লাস করা যায়। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী বা গৃহবধূদের কাছে অনলাইন শিক্ষা এক সুবর্ণ সুযোগ।
  2. অনলাইন শিক্ষায় অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে নিজস্ব বিষয়ের পাশাপশি বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রস্তুতি, সাথে সাথে বিভিন্ন দক্ষতা বাড়ানো কোর্স, শৈল্পিক কোনো কোর্সের থেকেও শিক্ষা নেওয়া যায়।
  3. শুধুমাত্র অনলাইন ক্লাস নয় অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতিতে অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন, ফর্মফিলাপ এমনকি লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভা পরীক্ষাও দেওয়া যায়। 
  4. নিজের বাড়িতে থেকেও দেশ বিদেশের বিভিন্ন বৈঠক, ওয়েবনার এ যোগদান করা যায়, জ্ঞানলাভ করে সমৃদ্ধ হওয়া যায়।
  5. অনলাইন ক্লাসের অধিকাংশের রেকর্ড থাকে, তাই প্রয়োজনে একাধিক বার ক্লাসগুলি দেখতে পারা যায়। ফলে বুঝতে না-পারা বিষয়গুলো বুঝতে অনেকটাই সুবিধা হয়, বিশেষ করে দুর্বল শিক্ষার্থীদের পক্ষে এই পদ্ধতি খুব উপকারে লাগে।
  6. নিজেদের ক্লাসের বাইরেও অন্যান্য অভিজ্ঞ শিক্ষকদের ক্লাসের ভিডিও দেখে বা সহযোগিতা পেয়ে = জটিল বিষয়েও আলোচনা করা যায়।
  7. আবার পড়াশোনার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হলেও অনলাইনে পড়াশোনায় অল্প অর্থ ব্যয় করে প্রচুর পড়া যায়।

অনলাইন শিক্ষার সুবিধাসমূহ:

অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতির বিভিন্ন সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি সেখানে বিভিন্ন অসুবিধাও রয়েছে। আর তার ফলেই অনলাইন ক্লাস শুরু অনেক দিন অতিবাহিত হলেও কাঙ্খিত সফলতা আসছে না। অসুবিধাগুলির মধ্যে অন্যতম—

  1. সঠিক অনলাইন ক্লাসের জন্য কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট বা অ্যান্ড্রোয়েড সেটের প্রয়োজন। যা দরিদ্র অনুন্নত গ্রামাঞ্চলের অনেক শিক্ষার্থীর কাছে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। ফলে এইসব অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ৫-১০ জনও অনলাইন ক্লাস করতে পারে না।
  2. পর্যাপ্ত নেটওয়ার্কের অসুবিধা অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতির সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। কেননা থ্রিজি, ফোরজি নেটওয়ার্ক বা ব্রডব্যান্ড সুবিধার প্রয়োজন থাকলেও দুর্গম অঞ্চল বা গ্রামাঞ্চলে তার আশা করা যায় না। 
  3. আবার অনলাইন ক্লাসের মধ্যেও বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে মোবাইল বা কম্পিউটারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের চক্ষু ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা বা মেসেজে মেতে ওঠে। 
  4. ভার্চুয়াল ক্লাসের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না- থাকায় অনেক দক্ষ দক্ষ শিক্ষকও ক্যামেরা ভীতির কারণে বা আরো অন্যান্য কারণে সুন্দর অনলাইন ক্লাস তৈরি করতে পারে না বা পারলেও তাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। যা একটি সার্থক ক্লাসের পক্ষে বাধা হয়ে দাড়ায়।
  5. আবার অফলাইন পড়াশোনায় যেখানে শিক্ষার্থীর ক্লাসে উপস্থিত থেকে সমস্ত বিষয়গুলি অনুধাবন করার চেষ্টা করত সেখানে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীরা অভিভাবকের চক্ষু ফাকি দিয়ে বিভিন্ন ডিভাইস ও অ্যাপস ব্যবহার করে অম্লীল ভিডিয়ো, সাইবার ক্রাইম, হ্যাকিং প্রভৃতি কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছে।
  6. অনেকক্ষেত্রে অনলাইন ক্লাসের কিছু মৌলিক নিয়মে সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে মনের মতো প্রশ্ন করতে পারে না, আবার, রেকর্ডকৃত ক্লাস বা ফেসবুক লাইভ ক্লাস বা টিভিতে ব্যবস্থাকৃত ক্লাসেও তাৎক্ষণিক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
  7. অনলাইন ক্লাসে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইলেকট্রনিক কাছে বসে থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যা যেমন- চোখের সমস্যা, মানসিক অস্বস্থি, শিরদাড়া ও কোমরে ব্যাথা এমনকি হার্টের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
  8. অনলাইনে পড়াশোনায় শিক্ষার্থীরা কী শিখছে তা মূল্যায়ণ করা যেমন কঠিন হয়ে পড়ে, তেমনি তারা কতটা শিখছে সেটা পরীক্ষা করতে কঠিন হয়ে পড়ে।
  9. অনলাইন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি open access অথবা টুকে লিখে দেওয়ার ভাবনায় পর্যবসিত হওয়ায় বিষয়ের গভীরে শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করতে পারছে না।
  10. অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় সরাসরি শিক্ষক ও শিক্ষিকার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের ভাব বিনিময় না-হওয়ায় উভয়ের যোগাযোগ অনেকটা কৃত্রিম হয়ে গেছে।
  11. ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে বি. পি.এল এর সংখ্যাধিক্য সেখানে ওইসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা ছেড়ে অন্য জীবিকার সন্ধান করবে, ফলে শিক্ষায় dropout বাড়বে – শিক্ষা ব্যবস্থা আর সাধারণের আওতায় থাকবে না। শিশু শ্রমিক ও বেকারত্ব নতুন সমস্যা হয়ে দাড়াবে এবং দাঁড়িয়েছে।

গ্রহনীয় পদক্ষেপ:

অনলাইন ক্লাসকে বা শিক্ষা সার্বিক সাফল্যমণ্ডিত করলে শিক্ষক শিক্ষিকা, অভিভাবক, ছাত্রসমাজ সর্বোপরি সরকারেও কিছু গ্রহণীয় পদক্ষেপ আছে। শিক্ষক- শিক্ষিকাদের অবশ্যই অফলাইন ক্লাসের মতো করে বোর্ড, মার্কার, ডাস্টার ব্যবহার করে ক্যামেরার সামনে আসতে হবে, আবার শিক্ষার্থীদের শিক্ষককে যথাযথ সম্মান দিয়ে মনযোগ সহকারে ক্লাসে মন দিতে হবে, অভিভাবকদেরও ছেলে মেয়েদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখলে এবং সরকার বিনামূল্যে অনলাইন ক্লাস উপযোগী উপকরণ সরবরাহ বা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও অনলাইন শিক্ষা কার্যকরী হবে।

উপসংহার:

বৈশ্বিক মহামারিতে থমকে না-দাঁড়িয়ে উন্নয়নের সকল কাজের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষা এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ। যদিও তা সর্বক্ষেত্রে সাফল্য। লাভ করেনি তবুও থমকে যাওয়া সভ্যতার চাকাকে এক পদক্ষেপ এগিয়ে দিয়েছে এই অনলাইন শিক্ষা। তবে এ পদ্ধতি সবদিনের জন্য কার্যকরী হোক – এ বিষয়ে আমরা কেউ সহমত নই। অতিমারি শেষে আবার শিশুদের কোলাহলে বিদ্যালয় মুখর হওয়ার অপেক্ষার আমরা আছি, আর সেই দিন আস্তে আস্তে আসছে। এক্ষেত্রে কবিতার একটা লাইন খুবই প্রাসঙ্গিক—

“আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে, 

আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে”।

আরও পড়ুন

  • বৃক্ষচ্ছেদন ও তার প্রতিকার Read →
  • নবজাগরণের পথে বাংলার লোক সংস্কৃতি Read →
  • রক্তদান জীবনদান প্রবন্ধ Read →
  • ফেসবুক : সোশ্যাল মিডিয়া রচনা Read →
  • করোনাকালে অনলাইন শিক্ষা Read →
  • YouTube-এর গুরুত্ব, সুফল, কুফল Read →
  • ডেঙ্গি একটি ভয়াবহ রোগ Read →
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ছাত্রসমাজ Read →
  • বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ? বিজ্ঞানের অশুভ দিক এবং শুভঃ দিক গুলি Read →
  • বিজ্ঞান ও কুসংস্কার বাংলা প্রবন্ধ রচনা Read →
  • তোমার প্রিয় কবি বাংলা প্রবন্ধ রচনা Read →
  • মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা বাংলা প্রবন্ধ রচনা Read →
  • তোমার প্রিয় চলচ্চিত্র : পথের পাঁচালী বাংলা প্রবন্ধ রচনা Read →
  • ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য বাংলা প্রবন্ধ রচনা Read →
  • একজন আদর্শ স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বাংলা রচনা Read →
  • মোবাইল ফোন বাংলা প্রবন্ধ রচনা Read →
  • বিশ্ব উষ্ণায়ন বাংলা প্রবন্ধ রচনা Read →
  • বিজ্ঞানী আবদুল কালাম বাংলা রচনা Read →
  • করোনা ভাইরাস বাংলা রচনা Read →
  • সাহিত্যপাঠের মূল্য বাংলা রচনা Read →
  • বইপড়া বাংলা রচনা Read →
  • বইপড়া বাংলা রচনা Read →

Leave a Comment

error: Content is protected !!