বাংলার লোকসংস্কৃতি প্রবন্ধ রচনা | নবজাগরণের পথে বাংলার লোক সংস্কৃতি রচনা

আমাদের দেশে মানে বিশেষ করে আমাদের বাংলায় লোকসংস্কৃতিকে অনেক টাই বেশি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন, তাই আজকের এই পোস্টের মাধ্যমে আমরা “বাংলার লোকসংস্কৃতি : বাংলার প্রাণ নিয়ে এই প্রবন্ধ রচনাটি দিলাম।

বাংলার লোকসংস্কৃতি : বাংলার প্রাণ প্রবন্ধ রচনা

“আমার দেশের জারি সারি ভাটিয়ালি মুর্শিদি 

আরও কত সুরের সাথে মিশে আছে 

আমার মায়ের মুখ”— আশরফ সিদ্দিকী

ভূমিকা:

দীর্ঘকাল পূর্বে ভারতের পূর্বপ্রান্তে গড়ে ওঠে যে ভিন্ন স্বাদের সংস্কৃতি তা বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি। শিল্পকলায়, খাদ্য রসিকতায়, ঐতিহ্যে বাংলা সবার থেকে আলাদা। সভ্যতার সিঁড়ি বেয়ে বর্তমানে বাঙালি জাতি উন্নতির শিখরে আরোহণে উদ্যত হলেও বাঙালি সম্পূর্ণ রূপে বিস্মৃত হয়নি তার অতীত ঐতিহ্যকে। তাই শহর থেকে গ্রামে বহু রূপে আজও অব্যাহত বাংলার প্রাচীন সত্তা।

বাংলার সংস্কৃতির নানা দিক: 

বাঙালির চলনে-বলনে-চিন্তনে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও প্রাদেশিক বিভিন্ন স্থানে বিশেষত গ্রামবাসী, মফস্সল অধিবাসী ও আদিবাসীদের অবলম্বন করে আজও লালিতপালিত হচ্ছে বাংলার লোকসংস্কৃতি। এমনকি শহুরে জীবনেও অবসরের আস্বাদ এনে দেয় বাংলার প্রাচীন সত্তা তার গানের ছন্দে, নৃত্যের তালে, পূজার্চনার রীতিনীতিতে ও নাট্যবিলাসিতায়। শুধু তাই নয়, বর্তমানের আধুনিকতার সূর্যালোক প্রাপ্ত শহুরে জীবনের চলচ্চিত্র ধারাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে বাংলার লোকসংস্কৃতি।

বাংলার লোকসংগীত:

বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতিরূপ বাংলার লোকসংগীত। বাংলার অসংখ্য সংগীত সম্পদের মধ্যে ভাওয়াইয়া, চটকা, সারিগান, পটুয়া, সঙের গান, বাউলগান, কীর্তন, জারিগান, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা প্রভৃতি নাম উল্লেখযোগ্য। একতারা, দোতারা, ঢোল, বাঁশি কিংবা তবলাযোগে এই সকল সংগীত গীত হত। প্রেম, উপাচারসমূহ, দর্শন, ভক্তি, কর্ম ও শ্রম ইত্যাদি ছিল লোকসংগীতের বিষয়। বিংশ শতকের প্রথম লগ্ন থেকে বিভিন্ন আধুনিক সংগীতশিল্পীর প্রয়াসে এই ধরনের সংগীতের জনপ্রিয়তা পুনরায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলার লোকনৃত্য: 

বাংলার বিভিন্ন ধরনের ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির লোকনৃত্য তাদের নিজস্ব বিশিষ্টতা ও সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। এগুলির মধ্যে ছৌ-নাচ, গম্ভীরা নৃত্য, টুসু, সাঁওতালি নৃত্য, খেমটা নাচ, মুসলিমদের লাঠিনাচ, ঝুমুর নাচ প্রভৃতির নাম নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। সাধারণভাবে বিবাহ, পূজাপার্বণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহ কিংবা ফসল উৎপাদনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন ঘটে বাংলায়।

বাংলার লোকনাট্য:

শুধু নৃত্যগীতের সমাহারে নয় নাট্য-ঐতিহ্যও বাংলার লোকসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। বোলান, গম্ভীরা, পালাকীর্তন, ভাসান, ঘাটু, আলকাপ, পুতুলনাটক ইত্যাদি বাংলার লোকনাট্যের ঐতিহ্যের ধারার অনবদ্য কিছু সংযোজন। বিভিন্ন বীরত্বব্যত্মক কাহিনি, প্রেম ও বিরহ, পুরাণ—সবই ছিল লোকনাট্যের বিষয়। অবশ্য, লোকনাট্যের বিষয় হিসেবে সর্বাধিক প্রিয় ছিল পুরাণ ও দেবদেবী।

বাংলার লোকাচার সমূহ: 

প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যের প্রধান অঙ্গ তার দেবতা ও প্রকৃতি দ্বারা চালিত লোকাচার সমূহ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান ও বৃক্ষকে দেবজ্ঞানে পূজা করা প্রাচীন বাংলার প্রধান আচরণীয় বিষয় ছিল। সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুন্ডা—এই সকল উপজাতি নৃত্যগীত সহযোগে দেবতার পূজার্চনায় বিশ্বাসী ছিল।

মনসার পুজো, ধর্মদেবতার পুজো, শিবরাত্রি প্রতিপালনসহ বিভিন্ন ব্রতপালন বাংলার লোক-ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

বাংলার শিল্পকলা:

বাংলা তার শিল্পকলাতেও স্বয়ংসমৃদ্ধ। বাংলার শিল্প কলাকৃতির মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের আলপনা, পটুয়া শিল্প – যাদের মধ্যে কালীঘাটের পট অত্যন্ত বিখ্যাত এবং টেরাকোটার নাম উল্লেখযোগ্য। পটে যেমন অঙ্কিত হয় বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের দেহাবয়ব তেমনি পোড়ামাটি দিয়ে বিভিন্ন কলাকৃতি নির্মিত হয়ে থাকে টেরাকোটার কাজে। কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, নদিয়া, বাঁকুড়া প্রভৃতি স্থান এই সকল কলাকৃতির জন্য বিখ্যাত ছিল। 

বাংলার লোকসাহিত্য:

প্রাচীন বাংলায় বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার্চনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয় বিভিন্ন লোকসাহিত্য। 

যেমন, সর্পদেবী মনসার মাহাত্ম্য জ্ঞাপক মনসামঙ্গল, রাঢ়ের ধর্মদেবতার কাহিনি ধর্মমঙ্গল, দেবী চণ্ডীর কাহিনি চণ্ডীমঙ্গল ইত্যাদি। বিভিন্ন বাংলা মহাকাব্য, কবিতা, গীতিকাও এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য। যেমন— ময়মনসিংহ গীতিকা, নাথ গীতিকা, বিভিন্ন রূপকথা, রাজারাজড়ার গল্প, ঈশপের গল্প সব ক্ষেত্রেই বাংলার লৌকিক ঐতিহ্যের অবাধ বিচরণ।

উপসংহার:

বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতি বা ‘Folk Lore’-এরই ধারক হল বাংলার লোকসংগীত, লোকনাটক, লোকসাহিত্য, লোকনৃত্য ইত্যাদি। বাংলার প্রাচীনপন্থী ধ্যানধারণার সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধনে আজ অবশ্য মৃতপ্রায় লোকসংস্কৃতির ধারা পুনর্জাগরিত হয়েছে। তবে, বাংলার এই প্রাচীন ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণের ধারাকে বজায় রাখতে বাংলার লোকনাট্যকলা, আলপনা দেওয়ার মতো শিল্পকলাকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করতে হবে। তবেই এদের পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে।

অনুসরণে লেখা যায় : 1. বাংলার লোকসংস্কৃতি : বাংলার প্রাণ, 2. নবজাগরণের পথে বাংলার লোক সংস্কৃতি।

আরও পড়ুন

  • বৃক্ষচ্ছেদন ও তার প্রতিকার Read →
  • নবজাগরণের পথে বাংলার লোক সংস্কৃতি Read →
  • রক্তদান জীবনদান প্রবন্ধ Read →
  • ফেসবুক : সোশ্যাল মিডিয়া রচনা Read →
  • করোনাকালে অনলাইন শিক্ষা Read →
  • YouTube-এর গুরুত্ব, সুফল, কুফল Read →
  • ডেঙ্গি একটি ভয়াবহ রোগ Read →

Leave a Comment

error: Content is protected !!